জীবনে তো কত বিপ্লবী নেতার গল্প পড়েছেন ! আজ না হয় একটু কষ্ট করে একজন হার না মানা যোদ্ধার গল্প পড়ুন..আশা করছি ভালো লাগবে !!
-১৯৮৪ এর এক তপ্ত দুপুরে হঠাৎ খুব ঘামছেন পর্তুগালের এক ছোট্ট জায়গা মাদেইরার একজন সাধারন মালি জোসে আভেইর।
কারন টা কি?
খুবই সিম্পল,আবারো যে মা হতে চলেছেন তার স্ত্রী মারিয়া।
কিন্তু কেন এতো চিন্তা ??
এতে তো খুশি হওয়ার কথা আভেইর দম্পত্তির..কিন্তু তারা চিন্তিত কেনো ?
কারন একটাই… অর্থ;
এমনিতেই পরিবারের ৫ সদস্য এর অন্ন যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের,তার উপরে আবার নতুন অথিতি।
এ যেন মরার উপর খরার ঘা।
তাই আভেইর দম্পতি চাইলো অনাগত সন্তানটি নষ্ট করতে…কিন্তু হাসপাতাল থেকে জানানো হল যে সেটা এখন অসম্ভব ! কারন সন্তান যে মায়ের পেটে এখন অনেক পরিপক্ব হয়ে গিয়েছে;তাই এখন নষ্ট করতে চাইলে মারা যেতে পারেন মারিয়া।
যার ফলে সে যাত্রায় বেঁচে গেলো সেই অনাগত সন্তান টি।
যদিও মারিয়া তারপরেও গরম বিয়ার খেয়ে তাকে নষ্ট করার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছিলো..!
কিন্তু ঈশ্বর যাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে চায়, তাকে কি আর গরম বিয়ারে নষ্ট করা যায় !!
১৯৮৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি ,
অবশেষে এলো সেই মুহূর্তটি,আভেইর দম্পতির কোল জুড়ে এলো এক ফুটফুটে ছেলে সন্তান,অবশেষে আলোর মুখ দেখল জন্ম নেওয়ারে আগেই নষ্ট করতে চাওয়া সেই শিশু টি।
মূলত যুদ্ধ টা শুরু হয়েছিলো মায়ের গর্ভে আশার পর থেকেই।
তবে পৃথিবীতে আশার পরেই শুরু হয়েছিলো এক নতুন যুদ্ধের,বেঁচে থাকার যুদ্ধের।
ছোট্ট একটি ঘর..!
গাদাগাদি করে ঘুমাতে হতো ভাই বোনের সাথে।
টাকার অভাবে কোন সময় খেতে পারেন নি দামি কোন খাবার,সাধারন খাবারেই পেটপুঁজো করতে হয়েছে।
তাই হয়তো ছোট বেলায় দেখতে একদম লিকলিকে গড়নের ছিল।
ফুটবলের প্রতি ভালবাসার শুরু একদম ছোট বেলা থেকেই… ছোট্টকালে অন্যান্য শিশুর যেখানে পুতুল কোলে নিয়ে ঘুমোনোর অভ্যাস..ছোট্ট ছেলেটি সেখানে ফুটবল কোলে নিয়ে ঘুমোতো।
স্কুল জীবনে এতো ফুটবল প্রীতি দেখে তার শিক্ষক বলেছিল যে,”ফুটবল তোমাকে খাদ্য দিবে না।”
ভুল প্রমান করেছেন ঐ শিক্ষক কে।সত্যি একবার দেখতে ইচ্ছা করে ঐ শিক্ষক কে;উনি হয়তো বুঝতেই পারে নাই যে এটা কোন সাধারণ ছেলে নয়,এ যে ভবিষ্যতের বিশ্ব সেরা একজন হার না মানা ফুটবল যোদ্ধা ।
ছোট বেলায় খেলার মাঠে পরিচিত ছিল ছোট্ট মৌমাছি নামে;আর থাকবেই বা না কেনো ??
তাকে বল পায়ে ধরতে যে ঘাম ছুটে যেত অন্যদের !!
কেউ তার বাড়ানো বলে গোল না দিতে পারলে মাঠেই কেঁদে ফেলতেন বলে ক্র্যাই বেবি নামেই পরিচিত ছিল সে।
১৯৯৫ তে স্থানীও ক্লাব অ্যান্দরিনহায় ফুটবল জীবনের শুরু এই ছেলেটির, যেখানে তাঁর বাবা জোসে কাজ করতেন কিট ম্যান হিসেবে।
তারপর কয়েক বছর স্থানীয় ক্লাব নাসিওনাল এর হয়ে খেলার পর যোগ দেন স্পোর্টিং সিপি তে।
মূলত প্রফেশনাল জীবনের শুরু এখান থেকেই।
তাঁর মধ্যে ১৫ বছর বয়সে হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত হয় ছেলেটি ।
ডাক্তার দের মতে তাঁর উচিৎ ছিল ফুটবল ছেড়ে দেওয়া…কিন্তু যে জন্মই নিয়েছে ফুটবল বিশ্ব শাসন করার জন্য সে কেন হেরে যাবে?
ফিরে এলেন,এক বিজয়ী যোদ্ধার মতো।
খেলে গেলেন নিজের মতো করে..!
২০০৩ সালে তার জীবনে সব চেয়ে সেরা একটা ঘটনা ঘটে…
একটি ফুটবল ম্যাচে মুখোমুখি হয় স্পোর্টিং সিপি ও বিশ্বের অন্যতম সেরা টিম ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
সেই ম্যাচে মূলত ছেলেটির কাছেই হার মানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
চোখে পড়ে যান জহুরী স্যার আলেক্সের।
তিনি আর দেরি করেন নি…ফিরতি প্লেনেই উঠিয়ে নেন ছেলেটিকে।
ছেলেটি হয়ে যায় এক রেড ডেভিল সদস্য;যা তাকে পরবর্তীতে বিশ্ব সেরা হওয়ার পথে নিয়ে যায় অনেক দূর।
ম্যানচেস্টারে এসেই পরিধান করেন বেকহ্যাম চলে যাওয়ার পর ফাঁকা হওয়া রেডডেভিল দের ঐতিহ্যবাহী ৭ নম্বর জার্সি,যা আগে শোভা পেত জর্জ বেস্ট,এরিক ক্যান্টোনা এর মতো লিজেন্ড এর গায়ে।
সেই জার্সি গায়েই নতুন যুদ্ধ শুরু করলেন ছেলেটি..ফুটবল বিশ্ব শাসনের যুদ্ধ।
ফুটবল দেখা পেল এক নতুন জাদুকরের,কি নেই তাঁর জাদুর থলে তে?
যেন ফুটবল সৌন্দর্যে ঠাঁসা একটা থলে।
যখনই মাঠে নামেন তখনি তাঁর জাদু অবাক হয়ে দেখতো পুরো ফুটবল বিশ্ব।
২০০৫ সালে ছেলেটির জীবনে ঘটে যায় এক হৃদয় বিদারক ঘটনা;অতিরিক্ত মদ্যপানের কারনে মারা যায় ছেলেটির ফুটবলের সব চেয়ে বড় উৎসাহদাতা ও সবচেয়ে বড় দর্শক ছেলেটির বাব জোসে আভেইর।
যার কারনে ছেলেটি আজও মদ্য পান করে না।তাঁর এক মাস পর আবারো এক ধাক্কা খায় ছেলেটি.. বাবা হারানোর শোক কাটতে না কাটতেই মিথ্যে রেপ কেসে ফেঁসে যায় সে; যদিও পরে তা আর প্রমান হয় নি।
এতো কিছু হওয়ার পরেও ছেলেটি ধমে যাননি.. হারিয়ে যাওয়ার বদলে আরও ভয়ঙ্কার হয়ে ফিরে আসে সে।
ম্যানচেস্টার তৈরি করেন রুনি-তেভেজ নিয়ে এক ভয়ংকর অ্যাটাকিং ত্রয়ী।
জয় করতে থাকেন সম্ভাব্য সব।
অতঃপর ২০০৮ সালে এলো সেই মহেন্দ্রক্ষণ…সে বছর তাঁর অসাধারণ পার্ফমেন্সের কারনে ব্রাজিল রাজপুত্র কাকা ও আর্জেন্টাইন জাদুকর মেসি কে হারিয়ে জয় করেন সেরা ফুটবলার হওয়ার খেতাব।
২০০৯ সালে রেড ডেভিল শিবির ছেড়ে যোগ দেন ফুটবল বিশ্বের সেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে।
তাঁরপরই দৃশ্যপটের পরিবর্তন,বার্সা ও মেসির অমানবিক পার্ফমেন্সের কারনে ঢাকা পরে যায় ছেলেটির সাফল্য।কারন ছেলেটি সাফল্য পেলেও তাঁর দল রিয়াল মাদ্রিদের যাচ্ছিলো খারাপ সময়।
যার ফলে ছেলেটি হারায় তাঁর মুকুট।
পরাপর চার বার নিজের চোখের সামনে ফুটবল প্রতিদ্বন্দ্বী মেসি জয় করে নেয় ব্যালনডি’অর; আর ছেলেটি হয়ে থাকে নিরব দর্শক..!
নাহ এতো কিছুর পরও তিনি ভেঙ্গে পড়েন নি,হয়েছেন আরও ক্ষুরধার,আরও শক্তিশালী।
তিনি আবারো তাঁর হারানো মুকুট জিতেছেন।
২০০৮ এর পর ২০১৩ পর্যন্ত যেইটা ১-৪ ছিলো,এই ২০১৮ তে এসে সেইটা পার্থক্য এসে দাঁড়িয়েছে ৫-৫..!
যা সম্ভব হয়েছে ছেলেটির হার না মানা মানসিকতার কারণেই..!
শুধু কি তাই..?
একসময় উয়েফা বর্ষসেরা খেতাবটাতে যখন ২-১ পিছিয়ে ছিলেন মেসির থেকে..২০১৮ তে এসে সেটা..২-৩ এগিয়ে..!
এমনকি ছেলেটি ফিফা দ্যা বেষ্ট ও টানা দু,বার জিতেছেন..যেটা নেই তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মেসিরও..!
জাতীও দলেও যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে,জীবনের প্রথম টুর্নামেন্টেই ফাইনাল হারার স্বাদ নিতে হয় তাকে,ছোট্ট শিশুটি কেঁদেছিলেন খুব সেদিন।
তাকে সান্তনা দিতে এসে তৎকালীন পর্তুগীজ ফুটবল বরপুত্র ফিগো এর চোখ এ ছলছল করেছিলো।
হয়ত সেই কান্নার আড়ালেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দেশকে কিছু দেওয়ার।
তাই তো ইউসেবিও-ফিগো যা পারে নি তা করে দেখিয়েছে ছেলেটি…!!
দল কে দিয়েছে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরপার স্বাদ।
যাকে নিয়ে এতো কথা..যার এতো ইতিহাস.. কে সে ?
আপনার হয়তো বোঝতেই পারছেন ইনি কে হবেন..!
হ্যাঁ ওনি ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো..!
ওনি সেই রোনালদো যে নাকি গোল করলে নিউজ হয়না..কিন্তু গোল না করলে নিউজ হয়..!
হ্যাঁ ওনিই রোনালদো, যে নাকি তাঁর শরীরে ট্যাটু করেনা..বছরে দু’বার রক্তদান করে বলে..!
হ্যাঁ ওনিই হিংসুটে রোনালদো,যে নাকি মানবতার কারণে সৌদি বাদশা থেকে পবিত্র কোরআন উপহার সরূপ হিসেবে পায়..!
হ্যাঁ ওনিই রোনালদো যে নাকি সর্বদা ওপনলী মদ্য পান করা দেশে থেকেও মদ পান করেন না..!
আমরা তো ফিরে আসার কোনও গল্প শোনালে সেই মুখস্ত করা স্কটিশ রাজা রবার্ট এর গল্প শোনাতাম,কিন্তু এখন থেকে আমরা না হয় নিজের চোখে দেখা এই পর্তুগিজ যোদ্ধার গল্পই শোনাব।
যে কি না হারিয়ে যায় নি শত পরাজয়েও,যে কি না ভেঙ্গে পড়ে নি হাজারো আঘাতেও।
সে যে যোদ্ধা,এক জন হার না মানা সত্যি কারের যোদ্ধা…!!
[copied]